অনলাইন ডেস্ক:
অনলাইন ডেস্ক:
বর্ষার আগেই মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে পদ্মা। অসময়ের ভাঙনে উপজেলার বড় নওপাড়া, সুন্দিসার, বেজগাঁও ও গাঁওদিয়া গ্রামে বিলীন হচ্ছে বিস্তীর্ণ জনপদ। ফলে এসব এলাকার পদ্মার তীরে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।
অন্যদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে ভাঙ্নরোধে নতুন প্রকল্প চূড়ান্ত অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এর মধ্যে বুধবার রাতে ভাঙনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলার বেঁজগাঁও গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন, ওসমান গনি ও বাদশা মিয়ার বাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
এ ছাড়া কালবৈশাখি ঝড়ে পদ্মার উঁচু ঢেউয়ের আঘাতে মাটি সরে গেছে উপজেলা ভূমি অফিস থেকে ব্রাহ্মণগাঁও উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায়। এতে অনেকের বাড়িঘর হুমকির মুখে পড়েছে। মাটি সরে উপড়ে পড়েছে গাছপালা।
ভাঙনের শিকার হয়ে বাড়ি হারানো বেজগাঁও গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, “আমাগো সব শেষ হইয়া গেল। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো ব্যবস্থা নিলো না।” তিনি অভিযোগ করেন, পদ্মায় এখন হাজার হাজার বাল্কহেড দিয়ে বালু লুট করে নেওয়া হচ্ছে। এতে নদীতে ভাঙন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পদ্মায় হারিয়ে যাচ্ছে বাড়িঘর, ফসলি জমি, রাস্তা-ঘাট ও গাছপালা।
শুক্রবার ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল আউয়াল। তিনি বলেন, লৌহজং উপজেলার বেজঁগাওয়ে ভাঙনের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি। এছাড়া পদ্মা তীরবর্তী বড়নওপাড়া, সুন্দিসার ও গাওদিয়ায় ভাঙন চলছে।
শনিবার থেকে আপদকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় বালুর বস্তা ফেলা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। আকস্মিক ভাঙনের তীব্রতা এমন বৃদ্ধি পাওয়ায় পদ্মী তীরের হাজারও পরিবার এখন দিশেহারা। নিজেদের সাজানো গোছানো ঠিকানা নিশ্চিহ্ন হওয়ার আতঙ্কে নদীপারের মানুষের চোখে ঘুম নেই।
বাড়িঘর রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। ভাঙনের আশংকায় বাড়িঘর সরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি অনেকেই গাছপালা কেটে নিচ্ছেন। অনেকের গাছে আম পাকতে শুরু করেছে কিন্তু সেই গাছও কেটে নিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। কেউ কেউ রশি-বাঁশ দিয়ে ভাঙনরোধের চেষ্টা চালাচ্ছেন। ভাঙনের আতঙ্কে ঘর-বাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন নদী পারের মানুষ।
বেজগাঁও গ্রামের নিরব হোসেন বলেন, “আমাদের তীরে এসে তরী ডোবার মত অবস্থা। প্রকল্প গ্রহণ করার পরও আমরা ভাঙনের মুখে। ভাঙন ঠেকাতে কেন ত্বরিৎ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।”
মনিরা বেগ অভিযোগ বলেন, “সরকার আমাগো ভাঙন রোধে কোটি কোটি টাকা দিছে কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড সময়মতো কাজটা করছে না, তাই আমাগো সর্বনাশ।”
ভুক্তভোগী গৃহবধূ তমালী বেগম বলেন, “তিন দিন আগেও নদী দূরে ছিল। গত দু’দিনের ঝড়ে ঢেউয়ের আঘাতে আমার ঘরের নিচের মাটি সরে গেছে। ভয়ে ছোট ছোট তিন সন্তান নিয়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি।”
তিনি বলেন, “দুই বছর আগে এনজিও থেকে কিস্তি নিয়ে এই ঘর তুলেছি। গত সপ্তাহে ঋণের কিস্তি শোধ করেছি। এখন ভাঙনের মুখে থাকা এই ঘর অন্য জায়গায় সরিয়ে নিতে অন্তত পাঁচ হাজার টাকা লাগবে।
“আমার স্বামী ঢাকার একটি দোকানের কর্মচারী। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি, ঘর সরাবো কীভাবে? ” প্রশ্ন এই অহসায় নারীর। সত্তরোর্ধ্ব হনুফা খাতুন বলেন, “তিনবার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছি। এবার ভাঙলে আর বাঁচার উপায় নাই আমাদের।”
তিনি সরকারের কাছে আপাতত বস্তা (জিও ব্যাগ) ফেলে এবং পরে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান। একটু দূরেই দেখা যায়, “লোকজন নিয়ে বাঁশ পুঁতে ভাঙন ঠেকাতে ব্যস্ত রাজ্জাক শেখ ও ওরফে রেজু শেখকে। তিনি বলেন, আমরা কি দোষ করেছি, আমাদের এলাকা কেন বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের বাইরে রাখা হলো? ”
সদ্য স্বামীহারা সফিনা ঘরের অর্ধেক নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে। তিনি তার এসএসসি পরীক্ষার্থী ছেলেকে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। তিনি না পারেন ঘরে থাকতে, না পারেন এলাকা ছেড়ে দূরে যেতে। এ ছাড়া আতঙ্কিত চান মিয়া, জিতু শেখ, ছাত্রলীগ নেতা শেখ মো. রিয়াদ নদী ভাঙনরোধে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। ভাঙন এলাকাকে প্রকল্পের আওতায় নিয়ে দ্রুত নদী শাসনের দাবি জানান তারা।
স্থানীয়রা জানান, ১৯৯২ সাল থেকে পদ্মা নদীর অব্যাহত ভাঙনে লৌহজং উপজেলা সদরসহ ৪০ গ্রাম এবং টঙ্গীবাড়ি উপজেলার ১০ গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। গত বছর থেকে জেলার লৌহজং উপজেলার খড়িয়া থেকে টঙ্গীবাড়ি উপজেলার দিঘিরপাড় পর্যন্ত ৯ দশমিক ১ কিলোমিটার এলাকায় পদ্মা তীর রক্ষা বাঁধ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে।
ভাঙন এলাকার মধ্যে গাওদিয়া, বড়নওপাড়া, সুন্দিসার, বাঘেরবাড়ি প্রকল্পের আওতায় থাকলেও রাউৎগাঁও প্রকল্পের বাইরে রয়েছে। এই রাউৎগাঁওয়েও এখন নদী ভাঙন প্রবল আকার ধারণ করেছে।
মুন্সীগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন, “ভাঙন ঠেকাতে ৪৪৬ কোটি টাকার রক্ষাবাঁধ প্রকল্প চলমান রয়েছে। গত বছরের এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া রক্ষাবাঁধ নির্মাণ শেষ হবে আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে। কাজের অগ্রগতি ২০ শতাংশ।”
তবে নতুন এলাকায় ভাঙন দেখা দেওয়ায় আরও ৩২ কোটি টাকার প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন আছে বলেও জানান এই প্রকৌশলী। মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি জানান, লৌহজং ও টঙ্গীবাড়ি উপজেলাকে পদ্মার ভাঙন থেকে রক্ষায় সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে।
তিনি বলেন, লৌহজংয়ের খড়িয়া থেকে টঙ্গীবাড়ির দিঘিরপাড় পর্যন্ত ৯ দশমিক এক শূন্য কিলোমিটার এলাকায় প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও এর বাইরে ভাঙন দেখা দিয়েছে। তাই আরও সাড়ে চার কিলোমিটার এলাকায় ভাঙনরোধে প্রকল্প প্রণয়নের প্রক্রিয়া চলছে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন শীঘ্রই বাকি অংশের কাজও শুরু হবে। একইসঙ্গে বর্ষার আগেই ভাঙনপ্রবণ এলাকার কাজ শেষ করার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে আহ্বান জানান এই সংসদ সদস্য।